ঢাকা,শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪

কেউ রাখেনি হাফিজা’র খবর !

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, লামা ::

বান্দরবানের লামায় পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সরকারী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গত ১৭ মার্চ ২০১৯ইং রোববার গাড়ি দূর্ঘটনায় নিহত মহিলা আনসার সদস্য (খন্ডকালীন) হাফিজা বেগম (৩৭) এর খবর কেউ রাখেনি, এমন অভিযোগ করেছে তার পরিবারের লোকজন। এমনকি তার লাশ দাফনের সময় লামার কোন সরকারী শীর্ষ কর্মকর্তা বা জনপ্রতিনিধিরাও উপস্থিত থেকে তাদের সান্তনা দেয়নি। দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে আত্মহুতি দেয়া একটি জীবনের কোন মূল্য ও সম্মান না দেয়ার বিষয়টি খুবই দূঃখজনক বলে জানিয়েছেন, লামার গজালিয়া বাজার পাড়াবাসি।

এদিকে ঘটনার ৭দিন পেরিয়ে গেলেও এই ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারটির খবর কেউ রাখেনি। বিষয়টি জানতে পেরে রোববার (২৪ মার্চ) প্রতিবেদক গেল অসহায় পরিবারটিকে দেখতে। নিহতের স্বামী মো. মোসলেম বলেন, গত ১৭ মার্চ লামা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আমার স্ত্রী হাফিজা বেগম খন্ডকালীন মহিলা আনসার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে লামার ফাইতং ইউনিয়নের পোলাউ পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে যায়। ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সময় পার্শ্ববর্তী চকরিয়া উপজেলার উত্তর হারবাং এলাকায় বিকাল ৩টায় পিকআপ গাড়িটি দূর্ঘটনায় পতিত হয়। এসময় প্রিজাইডিং, পোলিং অফিসার, পুলিশ, আনসার সহ মোট ১৬জন আহত হয়। সেই দূর্ঘটনায় আমার স্ত্রী গুরুতর আহত হলে তাকে দ্রুত পদুয়া সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে চমেক হাসপাতালে রেফার করে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে জরুরী বিভাগে দায়িত্বরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে বলেন, পথেই তার মৃত্যু হয়েছে। লাশের ময়নাতদন্ত শেষে ১৮ মার্চ সোমবার বাড়ির পাশের কবরস্থানে আমার স্ত্রীর লাশ দাফন করি। মাকে হারিয়ে আমার দুই সন্তান একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ছোট মেয়েটি সবসময় মায়ের জন্য কান্না করে। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। কিভাবে সংসারটি চলবে আল্লাহ জানে। দাফন-কাপন ও চিকিৎসার জন্য উপজেলা আনসার ভিডিপি অফিস থেকে উপজেলা প্রশিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর আমাকে ২০ হাজার টাকা দেয়। এছাড়া আর কোন সহায়তা আমরা পায়নি।

দেখা যায়, উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের বাজারপাড়ায় সরকারী জায়গায় একটি কুঁড়েঘর নির্মাণ করে বসবাস করে হাফিজার পরিবার। তার পরিবারে অসুস্থ স্বামী ও তিন কন্যা সন্তান আছে। বড় মেয়ে মুর্শিদার বিবাহ দেয়া হয়েছে। মেজ মেয়ে সুমি আক্তার (১৫) গজালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণী ও রেশমি আক্তার (৯) হেডম্যান পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীতে অধ্যায়ন করে। হাফিজা ও তার স্বামী অন্যের বাড়িতে দিনমজুরী করে তাদের সংসার চালাত। স্বামী-স্ত্রী দুইজনের উপার্জিত টাকায় কোনমতে খেয়ে না খেয়ে চলে যেত তাদের সংসার। কিন্তু হাফিজার মৃত্যুতে আধাঁর নেমে আসে পরিবারটির উপর।

নিহত হাফিজার মেজ মেয়ে সুমি আক্তার বলে, ছোট বোনটির কান্না থামাতে পারছিনা। সবসময় মা-মা করে। আমার মা দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, কিন্তু দেশের কর্তা ব্যক্তিরা তাকে সম্মান পর্যন্ত জানায়নি। আমার বাবা অসুস্থ। তার পক্ষে সংসার ও আমাদের লেখাপড়া চালিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। আমাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। সকালে পাশের বাড়ি হতে ২ কেজি চাল ধার করে এনে রান্না করেছি। আমাদের সুখি রাখতে গিয়ে মা জীবন দিয়েছে।

ছোট মেয়ে রেশমি আক্তার বলে, আমার মাকে আল্লাহ নিয়ে গেছে। তোমরা আমার মাকে এনে দাও। মা ছাড়া আমার ভাল লাগেনা। মাকে এনে না দিলে আমি কিছু খাবনা।

ঘটনাটির খুবই দুঃখজনক উল্লেখ করে ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার মো. মিজানুর রহমান বলেন, এইরকম হলে মানুষ দেশের জন্য কাজ করবেনা। দেশের কাজে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে হাফিজাকে। কিন্তু তার নূন্যতম প্রতিদান সে ও তার পরিবার এখনো পাইনি। এমনকি একজন কর্তা ব্যক্তি এসেও অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ায়নি। এই ঘটনায় গজালিয়ার আরো ১১জন মানুষ আহত হয়েছে। তাদের চিকিৎসার খবর ঠিকমত নেয়া হচ্ছেনা। গরীব মানুষ গুলোর কি অপরাধ ছিল ?

এই বিষয়ে উপজেলা আনসার ভিডিপি অফিসার সামিউল ইসলাম বলেন, আমি যেতে না পারলেও উপজেলা প্রশিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর কে পাঠানো হয়েছিল। দাফনের জন্য আপদকালীন ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছিল। তার ক্ষতিপূরণের বিষয়ে প্রক্রিয়া চলছে।

উপজেলা নির্বাচন অফিসার নববিন্দু নারায়ণ চাকমা বলেন, আমি ব্যস্ততার কারণে সরাসরি যেতে পারিনি বলে দুঃখিত। তবে আনসার ভিডিপির অফিসারের মাধ্যমে সমবেদনা জানিয়েছি। নিহত হাফিজার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আগামীমাসে ইসি সচিব লামায় আসার কথা আছে। তিনি নিজ হাতে ক্ষতিপূরণের টাকা নিহতের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করবেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-এ জান্নাত রুমি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, যেতে না পারলেও সার্বক্ষণিক তাদের খোঁজখবর রেখেছি। ক্ষতিপূরণের ফাইল দ্রুত তৈরি করে জেলায় পাঠানো হয়েছে। তারা নিশ্চিত ক্ষতিপূরণ পাবে।

পাঠকের মতামত: